শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২০

বাঙালির বৈশাখ

বাঙালির বৈশাখ
আ আ ম রওনক শাহরিয়ার রুহান

১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের কোন একদিন
ভারতবর্ষ
সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর কিছুদিন হল বঙ্গাব্দ চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন। আজ তার রাজসভায় সবার সামনে বঙ্গাব্দ উদ্বোধন করার কথা। কিন্তু আজকে তাঁকে ও তাঁর রাজসভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে রাজপ্রাসাদের কোত্থাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে ফতুল্লাহ বেশ কিছু দিন ধরেই একটা জ্যোতিবিজ্ঞান নিয়ে পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ চালাচ্ছিল। সম্রাটকে দেখাতে নিয়ে গিয়েই কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে ফেলেছে ফতুল্লাহ। তারা বছর সাল, স্থান ঘুরে ২০১৭ সাল তথা ১৪২৪ বঙ্গাব্দে পৌঁছে গেছেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের কাছাকাছি কোথাও পৌঁছছে। একজন আরেকজনের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতেই শুরু হয়ে গেল পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চমক, মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রচন্ড ভিড়! সম্রাটের বুক ফুলিয়ে রাজকীয় কায়দায় হাটবার জো নেই। এতক্ষন পর্যন্ত আমির ফতুল্লাহ সম্রাটের সাথেই ছিলেন। কিন্তু এখন আর ফতুল্লাহকে আর দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে শুধু রঙিন মুখোশ আর মুখোশ।
কিন্তু একটা পিচ্চি ছেলে সম্রাটের রাজকীয় কুর্তি টেনে ধরল।
বলল, “তোমাকে একদম সম্রাট আকবারের মতো দেখাচ্ছে। কুর্তিটা কোত্থথেকে কিনেছো? খুব-ব সুন্দর।”
সম্রাট আকবর রক্তচক্ষু নিয়ে বলল, “কীহ ! তামিজ নিয়ে কথা বল তুচ্ছ বালক। আর হ্যাঁ, আমাকে আকবারের মত দেখিতে নয়; আমিই তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবর।”
“বাহ আংকেল আপনার এক্টিংটাও ঠিক আকবরের মতোই হয়েছে। কেউ চিনতেই পারবে না।” বলেই ছেলেটি হো হো করে হাসতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা পাশেই এক গাছের তলায় বসে পড়ল। 
এদিকে কেউ সম্রাট আকবরকে পাত্তাই দিচ্ছে না। সবাই মনে করতে লাগল কেউ সম্রাট আকবর সেজেছে। মহামতি আকবর কোন উপায়ন্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত ছোট্ট ছেলেটির শরণাপন্ন হলেন। 
কিন্তু সম্রাট কোনমতেই বুঝতে পারছেন না ছেলেটের হাতে ওটা কি? আলো জ্বলছে আর ছেলেটা ওটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ছেলেটি জিনিসটাকে কানে ধরল। আর মহামতির দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতে লাগল।
আকাবর সদর্পে এসে বলল, “বাহ! তুমি সত্যই বিচক্ষণ বালক। একাধারে দুই ভাষায় কথা বলাটা সত্যই সুপান্ডিত্যের লক্ষণ। তবে তুমি কোন ভাষায় কথা বলিতেছিলে? চীনা না রোমান?” 
“চাইনিজ হতে যাবে কেন আংকেল? এটা তো ইংলিশ।”
“কিহ? হিঙ্গলিস? ও আমার বোধগম্য হয় না। সভাসদ বীরবল থাকিলে হয়ত বলিতে পারিত। তা বৎস তোমার পিতা-মাতা কোথায়?” 
“আসলে আমি মঙ্গলশোভা যাত্রায় হারিয়ে গেছি। কিন্তু ভয় নেই, বাবা-মাকে ফোন করেছি। ওনারা আসছেন।”
সম্রাট আকবর বিশেষ কিছুই বুঝলেন না। না বুঝেই মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি দিলেন। পরে না আবার সম্রাতের মর্যাদাটা খোয়া যায় অবোধ শিশুর কাছে। 
তবুও তিনি বললেন, “দেখ! বোধ করি ফতুল্লাহ আবার সব ঠিক করে দেবে। কিন্তু এখন আমার চারপাশে যা ঘটিতেছে তার সবই আমার বোধাতীত। তুমি কি আমাকে বলিবে কি হচ্ছে এসব?"
“ওমা, কেন? জানেন না? আজ তো পহেলা বৈশাখ। আর এখন মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে। দেখছেন না ইয়া বড় বড় প্রতিকৃতি।”
“একটু খোলসা করে বলবে?”
“দাড়ান । বিস্তারিত বলছি। মনযোগ দিয়ে শুনবেন”
মহামতি আবার দেখলেন ছেলেটা জিনিসটার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর এনাগাড়ে কিছু বলতে লাগল। বাংলা ভাষাতেই বলছে তবে শুনতে একটু অন্যরকম লাগছে।
“ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মানুষ কিছু আনন্দ এবং স্মৃতিকে আপন করে নেয়। আর এ আপন করে নেওয়ার বিভিন্ন স্তর এবং সময়ের পথ ধরে এগিয়ে চলে সংস্কৃতির বিকাশ। প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে পালন করে খুঁজে পায় নিজেকে। পায় আত্মতৃপ্তি। তেমনি আমাদের বাঙালি জাতির সার্বজনীন ও সর্বপ্রধান উৎসব হল বাংলা নববর্ষ। 
পহেলা বৈশাখের ইতিহাস বেশ প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। আর এটিকে বাঙ্গালিরা খুব সহজেই আপন করে নিয়েছে। 
যার হাত ধরে বাংলা নববর্ষের গোড়পত্তন হয়েছে তিনি হলেন তৃতীয় মুঘল সম্রাট জালাল উদ্দিন মুহাম্মাদ আকবর। তার রাজ্য ছিল কৃষি প্রধান। খাজনা আদায়ের সকল কাজকর্ম চলত হিজরি সন অনুযায়ী। কিন্তু হিজরি পঞ্জিকা চন্দ্র নির্ভর। আর চান্দ্রবৎসর হত ৩৫৪ দিনে। অর্থাৎ সৌর বৎসর থেকে ১১-১২ দিন পেছনে। ফলে, হিজরি পঞ্জিকা ঋতু নির্ভর নয়। তাই রাজ্যে ঋতুভিত্তিক খাজনা আদায়ের জন্য তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রুপান্তরিত করার নির্দেশ দেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর কাজ শেষ হয় ১৫৮৪ সালে (৯৯২ হিজরি) কিন্তু হঠাৎ রাজার ইচ্ছে হল আমার শাসন আমল থেকেই বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হবে। তাই বঙ্গাব্দকে পিছিয়ে যেতে হল ৩৯ বছর একদম ৯৬৩ হিজরি। আর ৯৬৩ সনে আরবি প্রথম মাস মুহাররম ছিল বৈশাখ মাসে। তাই বৈশাখ হল বঙ্গাব্দর প্রথম মাস। 
তবে বঙ্গাব্দ চালু করাটা মোটেও সহজ ছিল না। আর জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ নক্ষত্র মন্ডলের বিশেষত চন্দ্র আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে বাংলা মাস গুলোর নামকরণ করেন আর সপ্তাহের সাতদিন যে সাতটি গ্রহের নামে করা তা বলাই বাহুল্য। যেমন বৈশাখ মাসের নাম করণ হয়েছে বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে।
সূর্যকে প্রদক্ষিন করতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। আর যেহেতু গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি ৩৬৫ দিনের। তাই এই ব্যাবধান ঘোচাতে ৪ বছর পর ফেব্রুয়ারি মাসে একদিন যোগ করা হয়। কিন্তু বঙ্গাব্দে সে ব্যাবস্থা নেই। তাই ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। এটি হল-
বঙ্গাব্দের প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ হতে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের এবং আশ্বিন হতে চৈত্র ৩০ দিনের মাস হবে। আর প্রতি চতুর্থ বছরে ফাল্গুন মাসে একদিন যোগ করা হবে। 
বাংলা নববর্ষ পালন করতে বাঙ্গালির একটি ঐতিহ্য আছে। আছে আলাদা সংস্কৃতি। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙ্গালিদের আলাদা সুনাম আছে। বৈশাখী মেলা, লাল পেড়ো শাড়ী, লাল সাদা পাঞ্জাবী দুই বাংলার মানুষের মধ্যেই লক্ষ্যণীয় হলেও এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ঢাকা নগরীতেই মঙ্গল শোভাযাত্রা হত। তবে ১৪২৪ বঙ্গাব্দে কলকাতায় প্রথম বারের মত মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই ইতিহাসটা ১৯৮৯ সালের। অনেক আগে। তাছাড়াও ১৯৬৯ সাল থেকে সূচিত রমনার বটমূলে ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠান নতুন বছরের নতুন সূর্যকেই আহ্ববান করে। 
এসব আপন মনে শোনাচ্ছিল সম্রাট আকবর কে। হঠাৎ---
“কিয়ান কিয়ান!! কি করছো? কখন থেকে খুঁজেই চলেছি। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি কাকে এসব শোনাচ্ছিলে?”
কিয়ানের মা-বাবা এসে গেছে। 
“ও, এক অদ্ভুত আংকেলকে।”
“কোথায় তিনি?”
“এইইই.. তাই তো কোথায়। আমার সামনেই তো এতক্ষণ ছিল।”
“হয়েছে, হয়েছে নাটক করতে হবে না।”
“না মা আমি সত্যি বলছি।”
“হুম আমি জানি তো তুমি সত্যিই বলছ। এর আগে আমাকে যখন বোকা বানাতে তখনও তুমি সত্যিই বলেছিলে বাবা। আমি চিনি তো তোমায়।”
কিয়ান প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে চারুকলা অনুষদের আসে। তার নজর রঙিন খেলনাগুলোতে নয় বরং সে খুঁজছে সেই সম্রাট আকবরকে। কিন্তু কিয়ান তার চিহ্নমাত্র পায় না। কি জানি ফতেউল্লাহ সব ঠিক করে দিয়েছিল কিনা!

কোন মন্তব্য নেই: